পাহাড়ের পাশে ইটভাটা স্থাপন করে পাহাড় কেটে নষ্ট করা হচ্ছে জীববৈচিত্র, পাহাড়ের মাটি ও কৃষি জমির টপসয়েল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট, যেন করার কিছুই নেই…
আবদুল আউয়াল জনি, সিটিজি ভয়েস টিভি:
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিভিন্ন ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্টান, বনাঞ্চল ও চাষাবাদের জমিতে ৫৩টি ইটভাটার প্রভাবে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে এসব ভাটায় কৃষিজমি ,পাহাড়ের মাটি ব্যাবহার ও বনের কাঠ পোড়ানোর কারনে পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়ছে।এতকিছুর পরও পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছেন ঘুমের মধ্যে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-বাঁশখালী সীমান্তের এওচিয়া ইউনিয়নের চুড়ামণি এলাকায় গড়ে উঠা ১৭টি ইটভাটাগুলোর চারদিকে রয়েছে সবুজ পাহাড়। আর এসব পাহাড়ে রয়েছে সরকারি-বেসরকারীভাবে গড়ে উঠা গাছের বাগান। অন্যদিকে ইটভাটাগুলো স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য পাহাড় ও টিলা কেটে। এসব ভাটাগুলোর মধ্যে এমনও রয়েছে যা নিষিদ্ধ প্রযুক্তির ড্রাম চিমনী দিয়ে। আর ভাটাগুলোতে দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে পার্শবর্তী বনাঞ্চলের কাঠ।
অপরদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া উপজেলাধীন মৌলভীর দোকান হতে শিশুতল পর্যন্ত ৫কিলোমিটার দুরত্বে রয়েছে ৩৫টি ইটভাটা। এসব ভাটার অধিকাংশে অবৈধভাবে ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা এসব ভাটাগুলোতে বনাঞ্চল উজাড় করে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্টানের পাশে ও কৃষিজমির মধ্যে এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। যার অধিকাংশ ভাটার কোন বৈধ অনুমতি আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এসব ইটভাটার প্রভাবে এলাকার অনেক কৃষি জমি বিশাল বিশাল গর্তে পরিণত হয়ে কৃষি জমির শেষ চিহৃটুকু পর্যন্ত মুছে যাচ্ছে। সরকারের পরিবেশ আইন অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্টান, কৃষিজমি, বনাঞ্চল ও পাহাড়ের পাদদেশে ইটভাটা স্থাপনে সম্পূর্ণ বিধি-নিষেধ থাকলেও এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে এখানকার ভাটা মালিকেরা তাদের অবৈধ কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি আইন যেন তাদের কাছে ছেলের হাতের মোয়া। ভাটার কালোধুয়ায় যেসব শিক্ষা প্রতিষ্টানের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছেন সেসকল প্রতিষ্টানগুলো হল, রসুলাবাদ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা, জাফর আহমদ চৌধুরী কলেজ, রসুরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর সাতকানিয়া আলী আহমদ প্রাণহরি উচ্চ বিদ্যালয়,ওবাইদিয়া মাদ্রাসা, ছদাহা কে কে উচ্চ বিদ্যালয়।
ভাটার চিমনী থেকে নির্গত কাঁলো ধোঁয়ার প্রভাবে বনাঞ্চলের গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। আর নির্বিচারে পাহাড়ী এলাকার গাছ নিধনের ফলে বন্যপ্রানীরা বনাঞ্চল ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এতে জানমাল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় গরীব কৃষক ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোর উপর। প্রতিবছর নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে উঠায় সাতকানিয়ায় কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ।
ইটভাটা নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার ও ইটভাটা নির্মাণ স্থানের দিক নির্দেশনামূলক সরকারি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত আইন অনুযায়ী ইটভাটা নির্মাণের জন্য কেবল অকৃষি জমি ব্যবহার করা যাবে। কয়লা মজুদ করা না হলে লাইসেন্স নবায়নে সরকারি বিধি-নিষেধ রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ফসলের মাঠে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। অথচ এখানকার ইটভাটা গুলো ফসলের মাঠ ও গ্রামের আশে পাশে, শিক্ষা প্রতিষ্টানের পাশে এবং বনাঞ্চলের পাশে অবস্থিত। ইটভাটা নির্মাণের অনেক শর্ত থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। পরিবেশ বান্ধব চিমনী স্থাপন করা ইটভাটা নির্মাণের পূর্ব শর্ত। এসব বিধান থাকলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মনির আহমদ উক্ত ইটভাটার কার্যক্রমে অতিষ্ট হয়ে সিটিজি ভয়েস টিভিকে বলেন, তিনি চান সাতকানিয়ার সমস্ত ইটভাটা ব›ধ হয়ে যাক। ইটভাটার মাটি কাটতে কাটতে কেরাণীহাটের উত্তর পশ্চিম পার্শ্বে বিশাল এলাকা গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। ইটভাটার স্তুপকৃত মাটির কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি জমে দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে জনগণ অনেকে পানিবন্দী জীবন যাপন করেন। কেরাণীহাট এলাকার ইটভাটার কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের অনেক মুল্যবান গাছ মরে গেছে। তাছাড়া ইটভাটায় মাটি নিয়ে যাওয়ার কারণে মহাসড়কে যেসমস্ত মাটি পড়ে তার উপর বৃষ্টি হলে রাস্তা হয় পিচ্ছিল। যার ফলে বিগত দিনে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে।
উপজেলাধীন আলহাজ্ব জাফর আহমদ চৌধূরী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মিজবাহ উদ্দিন ও ছদাহা কে,কে,উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেনির ছাত্র খোরশেদ আলম বলেন,তাদের প্রতিষ্টানের পাশেই ইটভাটা। সকালের রোদ বাড়ার সাথে সাথে ইটভাটার ধুয়ার বিকট গন্ধে ক্লাসে খুব কষ্ট হয়।
সাতকানিয়া ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন এর নিকট এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা পাহাড় কাটে তাদের সাথে আমাদের সমিতির স¤পর্ক নেই। উক্ত ব্যাপারে চেয়ারম্যান মানিক জানে বলে মুঠোফোন কেটে দেন।
সাতকানিয়া স্ব্যাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম বলেন,ইটভাটার কালো ধোয়ার কারণে, শিশুসহ সাধারণ জনগণের মুখে, চোখে প্রদাহ ও শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হয়।
চট্টগ্রাম মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মুখলেছুর রহমান ফরহাদী বলেন, সাতকানিয়ার যত্রতত্র ইটভাটার কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র আজ হুমকীর মুখে।
এব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক হারুন অর রশিদ পাঠান এর নিকট সাতকানিয়া উপজেলার ইটভাটাগুলোর মধ্যে কয়টি ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান এ ব্যাপারে তাদের ডিডি স্যারের সাথে কথা বলতে বলেন।
এব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার এর মুঠোফোনে (০১৯১৬-৩২৮০৯০) পরপর দুইদিন(৫ ও ৬ ডিসেম্বর-২০১৯) কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।গত ৮ ডিসেম্বর তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করে বলেন, আইটিআর ফরম পুরন করে পাঠান তাহলে সাতকানিয়ার ইটভাটার সব তথ্য জানাব।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় সিটিজি ভয়েস টিভিকে জানান, উনার জানা মতে উপজেলায় ৫৩টি ইটভাটা রয়েছে। এসকল ইটভাটায় যে হারে জমির টপসয়েল ব্যাবহার করছে তার ক্ষতি বলে বর্ননা করে যাবে না। উক্ত ব্যাপারে এলাকার সকল স্তরের জনগণকে বেশি করে সচেতন হতে হবে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেখানে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিব, যারা বৈধ ভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কাঠ পুড়াচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে, অনেকগুলো অবৈধ ইটভাটা থাকলেও মহামান্য হাইকোর্টে ভাটা মালিকদের রিট এর কারণে এসব ভাটায় অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়না।