করোনা পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মক্কারো বলি খেলা বন্ধ

সিটিজি ভয়েস টিভি ডেস্ক:

এ বছর হচ্ছে না ঐতিহ্যবাহী সাতকানিয়ার ‘মক্কার বলি খেলা’। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ মেলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আয়োজকরা।

প্রতিবছর বৈশাখের ৭ তারিখে মক্কার বলি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও ২০ এপ্রিল (৭ বৈশাখ) ১৪০তম মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

জানা গেছে, এখন থেকে ৩০০ বছর পূর্বে সৌদি আরবের মক্কার বাসিন্দা ইয়াছিন মক্কী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসেন এবং সাতকানিয়ার মাদার্শার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকে এলাকাটি মক্কা বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইয়াছিন মক্কী এলাকায় ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি কিছু ব্যবসাও শুরু করেন।

হজ্জ মৌসুমে তিনি বাংলাদেশের অনেক হাজীকে হজ্জ করানোর জন্য সৌদি আরব নিয়ে যেতেন। এক সময় তিনি সাতকানিয়ার মাদার্শা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে সুবাদে সাতকানিয়া ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে তিনি বিপুল পরিমাণ ভূমি কিনে নেন। বিয়েও করেন বাংলাদেশ থেকে।

ইয়াছিন মক্কী এক হজ্জ মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু হাজ্বী নিয়ে সৌদি আরবে যান। সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ইয়াছিন মক্কীর পরবর্তী প্রজন্ম জমিদারি প্রথা চালু করেন।

১৮৭৯ সালে ইয়াছিন মক্কীর ছেলে নাছির কাদের বক্স চৌধুরী খাজনা দিতে আসা প্রজা এবং এলাকার লোকজনকে আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম বলি খেলার আয়োজন করেন। এরপর থেকে এটি মক্কার বলি খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। আঞ্চলিক ভাষায় ‘মক্কারো বলি’ খেলা নামে স্থানীয়দের মাঝে বেশি পরিচিত।

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ৭ তারিখে সবাই দল বেঁধে খাজনা দিতে আসতেন। ওই দিন মক্কার বাড়ি এলাকায় খাজনা দিতে আসা লোকজনের ভিড় জমে যেত। খাজনা দিতে আসা লোকদের জন্য মেজবানের আয়োজন করতেন নাছির কাদের বক্স চৌধুরী।

মূলত খাজনা দিতে আসা লোকজন ও এলাকার মানুষকে বাড়তি আনন্দ দিতেই বলি খেলার আয়োজন করা হতো। শুরুর দিকে বিশালাকৃতির একটি গাছের টুকরোর মাধ্যমে বলি খেলা হতো। বাড়ির সামনে বিশালাকৃতির একটি গাছ রাখা হতো। খাজনা দিতে আসা এবং স্থানীয়দের মধ্যে যারা ওই গাছের টুকরো উপরে তুলতে পারতেন তারাই বলি খেলার জন্য বিবেচিত হতেন।

গাছের টুকরা ওঠানোর যোগ্যতা অর্জন করতেন তাদের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। পরে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হতো।

বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন একটি আয়োজনের মধ্যে অন্যতম এটি। সাতকানিয়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে বলি খেলা দেখতে উৎসুক জনতার সমাগম হয়। কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়।

বলি খেলা উপলক্ষে মক্কার বাড়ির আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে বৈশাখী মেলা। মেলার আগের দিন থেকে দোকানিরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। সেখানে খাবার, কাপড়-চোপড়, কসমেটিকসের দোকান ছাড়াও বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসপত্র, নানা কৃষি উপকরণসহ গ্রামীণ পরিবারে সারা বছরের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায়।

লোকজন বলি খেলা উপভোগের পাশাপাশি মেলা থেকে ব্যবহারের সব জিনিসপত্রও কিনে নেন। সকাল থেকে মেলা বসলেও মূল আয়োজন শুরু হয় বিকালে। বিকালে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে খ্যাতনামা বলিদের অংশগ্রহণে শুরু হয় খেলা।

করোনা পরিস্থিতির কারণে বলি খেলার আয়োজন করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মেলার আয়োজক নাছির কাদের বক্স চৌধুরীর নাতি মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাজেমুল আলম চৌধুরী।

তিনি বলেন, আগামী ৭ বৈশাখ ঐতিহ্যবাহী মক্কার বলি খেলা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে জব্বারের বলি খেলার পর ঐতিহ্যবাহী এ খেলার অবস্থান।

মতামত