কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই!
আবদুল আউয়াল জনি, সিটিজি ভয়েস টিভি:
কভিট-১৯ নভেল করোনাভাইরাস, চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে, বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব, প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে করোনা, এতে প্রতিনিয়ত গড়ছে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও, ১৪ই এপ্রিল রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১৯,৪৭,৮৫৫ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ১,২১,৭৯৩ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪,৬০,২৩৮ জন মানুষ।
৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এখানেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ১৪ই এপ্রিল রিপোর্ট লেখা সময়ে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১০১২ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৬ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৪২ জন। চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষায় আরও ১৪ই এপ্রিল চট্টগ্রামের ১১ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এনিয়ে চট্টগ্রামে মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৭ জনে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৩০ জন। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে সর্বমোট ৯ শত ৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সুবিধা না থাকায় কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা চট্টগ্রামের করোনা ভাইরাসে আক্রান্তরা। সেবা নিশ্চিত করার লক্ষে গত ৪ঠা এপ্রিল চট্টগ্রামের করোনা ব্যবস্থাপনায় গঠিত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তক্রমে ৪ধাপে ১২টি বেসরকারি হাসপাতালের নাম লিপিবদ্ধ করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)। প্রথম থেকেই সংশয় ছিলো, বেসরকারি ক্লিনিকে করোনা রোগীর আইসিইউ সেবাপ্রাপ্তির বাস্তবতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! তালিকায় নাম থাকবে, পরিচালক বা সিভিল সার্জন সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করবেন আইসিইউ সেবাপ্রাপ্তি হাতের মুঠোয়, কিন্তু বাস্তবতায় সেবাবঞ্চিতই থাকবে চট্টগ্রামবাসী।
তেমনি ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রামের করোনা আক্রান্ত কয়েকজনের চিকিৎসা প্রদান করার সময়, এ যেন কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই! এসব বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও করোনা বিষয়ক সমন্বয় সেলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান।
সিটিজি ভয়েস টিভির পাঠকদের জন্য ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমানের ফেসবুক স্টাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হল…
কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই!
১. নগরীর সরাইপাড়ার ৫০ বছর বয়স্কা নারী জেনে যেতে পারেননি তিনি করোনাক্রান্ত ছিলেন।রিপোর্ট এসেছে রাতে,মারা গেছেন দুপুরেই।এই রোগীকে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি তার স্বজনসমেত নিয়ে এসেছিলেন গত রোববার রাতে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে।প্রথমে হৃদরোগ ওয়ার্ডে,পরে ১৪নং ওয়ার্ডে এসে রোগীটি ভর্তি হন।রাত গভীর হতে থাকে,রোগীর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে,রক্তে কমে যেতে থাকে অক্সিজেনের মাত্রা।কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ রোগের ইতিহাস ঘেঁটে , রোগী পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহ করেন ‘করোনা’।করোনা সন্দেহভাজন হওয়ায় এবং রোগীর ঐ মূহুর্তের চিকিৎসায় আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হবে নিশ্চিত হয়ে রোগীটি চট্টগ্রামের ‘কোভিড ডেজিগনেটেড জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য স্বজনদের পরামর্শ দেয়া হয়।জেনারেল হাসপাতাল গেলে রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে সংকটাপন্ন হবে আশংকায় রোগীকে নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে রেফার করা হলে স্বজনরা রোগীসমেত ওখানে যান।কিন্তু পার্কভিউ হাসপাতাল এই রোগী ভর্তিতে অপারগতা জানালে রোগী পুনরায় ফেরত আসেন জেনারেল হাসপাতাল।নথিতে যাই-ই লিপিবদ্ধ থাকুক,কর্ণধারগণ যাই বলুক, রোগীর সন্তান এমনই বলছেন।এবার তাকে ভর্তি রাখা হয় আইসোলেশন ওয়ার্ডে।তার নমুনা সংগ্রহের কাজও সম্পন্ন হয়।কিছুক্ষণ পর রোগীনি চলে যান, পরপারে,যেখানে রিপোর্ট পজিটিভ নেগেটিভ বা আইসিইউ’র ধার আর তাকে ধারতে হবে না।তীব্র বেদনায় কি নীল হয়ে গেছিলো তার শরীর!
২.এ রোগীর মৃত্যুর ৮ ঘন্টা আগে পটিয়ার ছ’বছর বয়সী শিশুটিও শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা যায়।এই শিশুটি আরো আগে হাসপাতালে এলে তাকেও কি প্রয়োজনীয় আইসিইউ সেবা দেয়া যেতো?ছ’বছরের শিশুর লাশ হাতে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিতা’র ছবি চাঁটগাবাসী কাঁদাচ্ছে,অকাতরে।এ দুই রোগীকে আইসিইউ সেবা দেয়া গেলোনা,এমন আক্ষেপ আমাদের তাড়া করবেই,যদি আমাদের বিবেকবোধ খুন হয়ে না যায়।
৩. গত ৪ঠা এপ্রিল’২০ তারিখে চট্টগ্রামের করোনা ব্যবস্থাপনায় গঠিত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তক্রমে ৪ধাপে ১২টি বেসরকারি হাসপাতালের নাম লিপিবদ্ধ করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য)।১২ হাসপাতালের প্রথমটির নাম ‘পার্কভিউ’।তাহলে করোনা সংকটাপন্ন এ রোগী কেনো এ হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পেলেন না? প্রথম থেকেই সংশয় ছিলো,বেসরকারি ক্লিনিকে করোনা রোগীর আইসিইউ সেবাপ্রাপ্তির বাস্তবতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! তালিকায় নাম থাকবে, পরিচালক বা সিভিল সার্জন মহোদয়গণ সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করবেন আইসিইউ সেবাপ্রাপ্তি হাতের মুঠোয়, কিন্তু বাস্তবতা এটা সমর্থন করোনা,কোনমতেই।এ রোগী ভর্তিতে ডেজিগনেটেড করোনা আইসিইউ ক্লিনিক পার্কভিউ’র অনীহা বা প্রত্যাখ্যান আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কি তাই-ই প্রমাণ করছে না?
৪.আমাদের তো অপশন ছিলো,আছে।জেনারেল হাসপাতালে ১০টি ভেন্টিলেটর,আইসিইউ শয্যাসহ সরন্জাম পৌঁছেছে ৭দিন পেরিয়ে গেছে,কাজ শেষ করানো যাচ্ছে না।তিন বছর ধরে স্টোরে পড়ে থাকা আরো ৮ ভেন্টিলেটর,আইসিইউ শয্যা ব্যবহারে মন্ত্রণালয়ের আদেশ,যদি আদৌ প্রয়োজন পড়ে,আনা যায়নি করোনার ৩৮তম দিনেও! করোনাযজ্ঞের প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার ক্ষেত্র সরকারী ব্যবস্থাপনার জেনারেল হাসপাতালই, কোনভাবেই বেসরকারি ক্লিনিক নয়।এ বিষয়টি যত দ্রুত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য প্রশাসন অনুধাবন করতে সমর্থ হবেন,ততই চট্টগ্রামবাসীর মঙ্গল।নাকি বেসরকারি ক্লিনিক মালিকদের আইসিইউ সেবার আয়োজন সম্পন্ন না হওয়া অব্ধি এ লোকদেখানো,ছেলেভুলানো খেলার লুকোচুরিতে মেতে থাকবো সবাই?
৫. চট্টগ্রামের বড় হৃদয়ের মানুষজন এগিয়ে আসছেন জরুরী ব্যবস্থাপনায় করোনা হাসপাতাল বিনির্মানে, এ উদ্যোগের বাস্তবতা সময়সাপেক্ষ, তবুও সাধুবাদযোগ্য। প্রাথমিক বিপর্যয় সামলাতে সরকারী ব্যবস্থাপনার জেনারেল হাসপাতালকেই দ্রুততম সময়ে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। নইলে আইসিইউ শয্যার ১২ ক্লিনিকের তালিকা আমাদের উপহাস করবে ,নিশ্চিত। ‘কাজীর গরু কেতাব আছে,গোয়ালে নেই!’ -আমরা চট্টগ্রামবাসীকে যেন এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে না দেই।
পুনশ্চ: এই পুরো অব্যবস্থাপনার কোনটির জন্যই কোন ক্ষেত্রে,কোন চিকিৎসকই কিন্তু দায়ী নন।চিকিৎসকরাই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন,পরম পবিত্রতায়।যুদ্ধক্ষেত্রে যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের দায়িত্বপালনকারীগণ যেন তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে চিকিৎসকদের উপর দোষ না চাপান।
এবিষয়ে জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও করোনা বিষয়ক সমন্বয় সেলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান সিটিজি ভয়েস টিভিকে বলেন, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) তে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত সর্বমোট ৯ শত ৪ জনের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তৎমধ্যে ১৪ই এপ্রিল চট্টগ্রামের ১১ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এনিয়ে চট্টগ্রামে মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৭ জনে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৩০ জনে। এমন সংকটকালীন মুহুর্ত শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমি আইসিইউ সংকট নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি আইসিইউ বাড়ানোর বিষয় নিয়ে বার বার জোর দিয়ে আসছিলাম আপদকালীন সময়ের জন্য ৪ ধাপে ১২টি বেসরকারি হাসপাতালে এই সুবিধা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয় করোনা সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কমিটি। অথচ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করার লক্ষ্যে ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্টোরে পড়ে আছে সরকার প্রদত্ত ৮ ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ বেডসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় সরন্জাম। ৩ বছরে এ উদ্যোগ তো নেয়াই হয়নি, এমনকি করোনার এই জাতীয় দূর্যোগেও আইসিইউ ইউনিটের কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনাটি কেউ মাথায়ই নেননি। না কর্তাগণ, না মেডিকেল ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগন।
ডা. মিনহাজ আরো বলেন, আই.সি.ইউ’র এ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে দুদক রুজু করা মামলা আদালতে চলমান।কিন্তু এ যন্ত্রপাতি হাসপাতালে ব্যবহার করা যাবে না এমন কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ৩ বছর ধরে এ যন্ত্রপাতিগুলো এভাবেই পড়ে আছে। একসময় মন্ত্রণালয় এ যন্ত্রপাতি হিরণ করা যাবে না মর্মে পত্র দিলেও পরবর্তীতে আদালতের আদেশে এগুলো গ্রহণ করা হয়। অর্থ্যাৎ স্টোরে ফেলে রাখা আই.সি.ইউ’র এ যন্ত্রপাতি দিয়ে ইউনিটটি চালু করা যেতো। খোদ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেই যেখানে মূমূর্ষ রোগীর আই.সি.ইউ শয্যাপ্রাপ্তি অবর্ননীয় ঝক্কিঝামেলার বিষয়, শয্যা সংকটের অভাবে, সেখানে জেনারেল হাসপাতালে আই.সি.ইউ ইউনিট চালু করা গেলে এখানে চট্টগ্রামবাসী কাংখিত সেবা পেতো,অনায়াসেই। এই করোনা দূর্যোগের প্রাথমিক পর্য্যায়ে আই.সি.ইউ নির্ধারণ করার জন্য গলদঘর্ম হয়ে কপালে বলিরেখার এতো ভাঁজ অন্তত: পড়তো না। চট্টগ্রামের বড় হৃদয়ের মানুষজন এগিয়ে আসছেন জরুরী ব্যবস্থাপনায় করোনা হাসপাতাল বিনির্মানে, এ উদ্যোগের বাস্তবতা সময়সাপেক্ষ, তবুও সাধুবাদযোগ্য। প্রাথমিক বিপর্যয় সামলাতে সরকারী ব্যবস্থাপনার জেনারেল হাসপাতালকেই দ্রুততম সময়ে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। এখনই যদি ব্যাবস্থা গ্রহণ করা না হয় সামনে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আমি মনেকরি।